ক্লাস, টিউটোরিয়াল পরীক্ষা কোনো কিছুরই প্রয়োজন নেই। টাকা দিলেই মিলছে যে কোন বিভাগের অনার্স-মাস্টার্সের সার্টিফিকেট। ভর্তিও দেখানো হবে নির্ধারিত সময়েই। থাকবে প্রতিটি সেমিস্টারে পরীক্ষার পৃথক পৃথক নম্বর। আর এজন্য বিশ্ববিদ্যালয় ভেদে গুনতে হচ্ছে ৩০ হাজার থেকে আট লাখ টাকা পর্যন্ত। উচ্চ শিক্ষাকে পণ্য বানিয়ে এক শ্রেণির শিক্ষা বেনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন নিয়ে খুলে বসেছেন ডিগ্রি বিক্রির দোকান। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের চটকদার বিজ্ঞাপন শোভা পাচ্ছে সর্বত্রই। রাজধানীর অলিতে-গলিতে ভবন ভাড়া করে খোলা হয়েছে অফিস ও ক্লাসরুম। ব্যতিক্রম নয়, দেশের অন্যান্য বড় শহরগুলোও।
কিন্তু এসব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস হয় না নিয়মিত, ভালোমানের ও যোগ্য শিক্ষক নেই, পরীক্ষাও দিতে হয় না। কিন্তু মিলছে সনদ। বিধান অনুযায়ী অনার্স সার্টিফিকেটের জন্য চার বছর এবং মাস্টার্স সার্টিফিকেটের জন্য এক বছর পড়াশোনা করতে হয়। এরপরই মিলে উচ্চশিক্ষার কাক্সিক্ষত সেই সার্টিফিকেট। কিন্তু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিয়মনীতি কিংবা বিধানকেই তোয়াক্কা না করে বরং টাকা দিলেই সাথে সাথেই দিয়ে দেয়া হচ্ছে উচ্চশিক্ষার এই সার্টিফিকেট। আর এসব সার্টিফিকেট দিয়েই অনেকে অংশ নিচ্ছেন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা কিংবা নিয়োগ পাচ্ছেন চাকরিতে। পদন্নোতিও হচ্ছে অনেকের। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বিপাকে পড়তে হয় এসব প্রতিষ্ঠান থেকে সনদ নেয়াদের। অনেক চাকরিদাতা প্রতিষ্ঠানেই মূল্যায়ন হয় না তাদের সার্টিফিকেট। কিন্তু তারপরও নানাভাবে আকৃষ্ট করার চেষ্টা চালাচ্ছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কেবলই সার্টিফিকেটনির্ভর বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে ইতোমধ্যে পরিচিত হয়ে পড়েছে অন্তত ১৫টি বিশ্ববিদ্যালয়। ৩০ থেকে ৫০ হাজার টাকা দিলেই মিলছে আমেরিকা বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটির সার্টিফিকেট। এর থেকে একটু বেশি দিলেই মিলছে প্রাইম ইউনিভার্সিটি, দারুল ইহসান, এশিয়ান, প্রিমিয়ার, কুইন্স ইউনিভার্সিটির সার্টিফিকেট। দেড় লাখ থেকে দুই লাখ টাকায় মিলছে ইবাইস, অতীশ দীপংকর, দ্য পিপলস, উত্তরা, সিলেটের লিডিং, ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল, রয়েল, গ্রিন, চট্টগ্রামের সাউদার্ন ইউনিভার্সিটির সার্টিফিকেট। পাঁচ থেকে আট লাখ টাকা দিলে দেশের শীর্ষ প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়েরও সার্টিফিকেট পাওয়া যাচ্ছে বলেও জানিয়েছে এই বাণিজ্যে সংযুক্ত কয়েকজন ব্যবসায়ী। জানা গেছে, বিবিএ, এলএলবি, এমবিএ, এলএলএম, বিএড, এমএড, বাংলা, ইংরেজি, কম্পিউটার সায়েন্স এবং সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংসহ বিভিন্ন বিষয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করতে শিক্ষার্থীকে কমপক্ষে ৪ থেকে ৬ বছর অধ্যয়ন করতে হয়। এ সময়ে বিভিন্ন পরীক্ষাসহ নানা ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার মুখোমুখি হতে হয় শিক্ষার্থীকে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, দীর্ঘ সময়ক্ষেপণ ও ঝক্কিঝামেলা মুক্ত সার্টিফিকেট পাওয়ার সব ধরনের ব্যবস্থা রয়েছে আমেরিকা বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটিতে। শুধু এই ইউনিভার্সিটিই নয়; নিজেদের নিরাপদ রাখতে এবং ব্যবসা সম্প্রসারণে তারা অতীশ দীপংকর ও চট্টগ্রামের সাউদার্ন ইউনিভার্সিটির সঙ্গে গোপন চুক্তি করে। ৮০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা দিয়ে এই দুই ইউনিভার্সিটি থেকে সার্টিফিকেট কিনে তা এক থেকে দেড় লাখ টাকায় শিক্ষার্থীদের কাছে বিক্রি করে। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, মাত্র ১০-১২ ব্যক্তি বছরের পর বছর মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করে উচ্চশিক্ষার সনদ নামের মূল্যহীন কাগজ বিলি করছেন। অনেকটা লাগামহীন ব্যবসার সুযোগ থাকায় অনেকে পারিবারিকভাবেও এই জাল-জালিয়াতির রাস্তায় নেমে পড়েছেন। আর এদের নানাভাবে মদদ দিয়ে যাচ্ছেন শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) দুর্নীতিবাজ কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী। মূলত শক্তিশালী সিন্ডিকেটের কারণেই প্রতারণার ব্যবসাসহ অবৈধ বিশ্ববিদ্যালয় এবং ক্যাম্পাস যেমন বন্ধ হচ্ছে না, তেমনি অপরাধীরাও থেকে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থিক নৈরাজ্য ও সার্টিফিকেট ব্যবসাসহ নানা প্রতারণামূলক কর্মকান্ডের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে জাতীয় সংসদের শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি তথ্য তলব করে। গত ২৬ জুন শিক্ষা মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে ১৯ পৃষ্ঠার তথ্য পাঠায় জাতীয় সংসদে। এতে অকপটে নানা ধরনের অনিয়ম-দুর্নীতির কথা উল্লেখ করেছে মন্ত্রণালয়। সর্বশেষ গত ৩০ জুন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। তাদের প্রতিবেদনে বলা হয়, ক্লাস না করিয়ে ও পরীক্ষা না নিয়ে এবং ব্যবহারিক ক্লাস না নিয়ে টাকার বিনিময়ে সনদ প্রদান করা হচ্ছে। তাদের গবেষণায় জনপ্রতি ৩ লাখ টাকা করে নিয়ে এ রকম একটি বিশ্ববিদ্যালয়েরই ৩০০ শিক্ষার্থীকে সনদ দেয়ার ঘটনা বেরিয়ে এসেছে। বুলবুল আহমেদ নামে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক বলেন, আমি যখন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম ক্লাস নেয়া শুরু করি তখন শতভাগ দেয়ার ইচ্ছে নিয়েই শুরু করেছিলাম। এরপর প্রথম পরীক্ষা শেষে যখন শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার খাতা দেয়া হলো তখন নির্ধারিত সময়ের পূর্বেই নম্বর চাওয়া হলো। তিনি জানালেন খাতা দেখা শেষ হয়নি। তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে বলা হলো খাতা দেখা লাগবে না সবাইকে ভালোভাবে নম্বর দিয়ে দেন। নম্বর কম পেলে ছাত্ররা এখানে ভর্তি হবে না। আর আপনিও শিক্ষক থাকতে পারবেন না। রাজধানী ছাড়িয়ে সারাদেশে : সনদ বাণিজ্য অত্যন্ত লাভজনক ও লোভাতুর ব্যবসা হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার পর সার্টিফিকেট বিক্রির মতো লাভজনক এই বাণিজ্য এখন আর কেবল রাজধানীতেই সীমাবদ্ধ নেই। রাজধানী ছাড়িয়ে পৌঁছে গেছে দেশের সব বিভাগীয় এবং বড় বড় জেলা শহরগুলোতে। বেসরকারি হিসেবে এ ধরনের বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা অন্তত সাড়ে তিনশ। এর মাধ্যমে তারা শিক্ষার্থীদের প্রতারিত করার পাশাপাশি হাতিয়ে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকা। জানা গেছে, এসব বিশ্ববিদ্যালয় কেবল সনদধারী গ্রাজুয়েটই নয়, কাঁড়ি কাঁড়ি শিক্ষকও তৈরি করছে। নানা শ্রেণী-পেশার মানুষকে ধরে এনে এসব প্রতিষ্ঠানে নামমাত্র পয়সায় শিক্ষকতার দায়িত্ব দেয়া হচ্ছে। গত ১৩ আগস্ট প্রকাশিত হয়েছে এইচএসসি পরীক্ষার ফল। ৭০ হাজারেরও বেশি শিক্ষার্থী জিপিএ-৫ পেয়েছে এই পরীক্ষায়। দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে রয়েছে আসন সমস্যা। জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীরাই ২০ হাজারের বেশি এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পাবে না। এছাড়া অন্যান্য জিপিএ ধারীরাতো আছেই। ফলে অনেকটা বাধ্য হয়েই অনেকে ঝুঁকবেন এই প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দিকে। অথচ দেশে বর্তমানে অবৈধ ও ভুয়া হিসেবে চার ধরনের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এগুলো হচ্ছে- এক সময়ে সরকার অনুমোদিত কিন্তু বর্তমানে বন্ধ ঘোষিত, সরকার অনুমোদিত হলেও তার ক্যাম্পাস অবৈধ, অবৈধ আউটার ক্যাম্পাস এবং অবৈধ বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়। এর বাইরে ৪টি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে যারা মালিকানা দ্বন্দ্ব থেকে সার্টিফিকেট বিক্রির প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছেন। মালিকানা দ্বন্দ্বের কারণে একই নামের দুটি পৃথক বিশ্ববিদ্যালয় এবং দু’জন পৃথক ভিসির স্বাক্ষর করা সার্টিফিকেট নিয়ে বের হচ্ছে শিক্ষার্থীরা। এর কোনটি আসল কিংবা কোনটি নকল তা নিয়ে যেন কারোরই মাথা ব্যথা নেই। সার্টিফিকেট সর্বস্ব গ্রাজুয়েট তৈরি করছে, এমন বিশ্ববিদ্যালয়ও রয়েছে অন্তত ১৫টি। আর ঢাকার বাইরের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো প্রায় অভিভাবক ছাড়াই চলছে। অনেকটা এক হাতে টাকা তো অন্য হাতে সার্টিফিকেট ধরনের। ওইসব প্রতিষ্ঠানে কখনও শিক্ষার্থীরা ভর্তি হয় ও কোনো রকমে লেখাপড়া করে সনদ নেয়। আবার কখনও শিক্ষার্থীরা কাগজে-কলমে ভর্তি হয়েই রাতারাতি অনার্স-মাস্টার্স ডিগ্রিধারী হয়ে যাচ্ছে। দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয় : এই বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে সনদ বাণিজ্যের অভিযোগ ও প্রমাণ দুটোই আছে। এমনকি তাদের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সনদ নিয়ে চাকরি প্রার্থী হয়ে হতাশ হতে হচ্ছে অনেক শিক্ষার্থীকেও। টাকা দিলেই এই বিশ্ববিদ্যালয়টির সনদ হাতে এমন কথা চালু আছে সবখানে। বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশনও এসব অভিযোগ তুলে বিশ্ববিদ্যালয়টি বন্ধ করে দেওয়ার সুপারিশ করেছে। এরপরই চার ভাগে বিভক্ত এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি পক্ষই আদালতে গিয়ে স্থগিতাদেশ নিয়ে এখন বহাল তবিয়তে চলছে। ইউজিসির তথ্য মতে রাজধানীতেই দারুল ইহসানের নামে চলছে শতাধিক অবৈধ ক্যাম্পাস। একেকটি ক্যাম্পাস থেকে গড়ে প্রতি মাসে এক কোটি টাকার সনদ বাণিজ্য হয়। চারটি ক্যাম্পাস থেকেই সনদ দেওয়া হচ্ছে দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয় নামে। কোনটি আসল আর কোনটি নকল জানতে পারছে না শিক্ষার্থীরা। এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ : সার্টিফিকেট বিক্রিতে এশিয়ান ইউনির্ভার্সিটি অনেকটা টাকা দাও সনদ নাও ধরনের। অভিযোগ রয়েছে, বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষায় সনদ বাণিজ্যের পথিকৃৎ এই বিশ্ববিদ্যালয় এবং এর ভিসি। টিআইবি’র প্রতিবেদনেও এই তথ্য এসেছে। বিশ্ববিদ্যালয়টি সম্পূর্ণ সনদনির্ভর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বলে উল্লেখ করেছে তাদের তদন্ত প্রতিবেদনে। ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের এক কর্মকর্তার সাথে যোগাযোগ করলে তিনি জানান, এখানে ভর্তি হলে নিয়মিত ক্লাস না করলেও চলবে। তবে কোর্স ও টিউশন ফি নিয়মিত দিতে হবে। ওই কর্মকর্তাকে সাংবাদিক পরিচয় দেয়ার পর তিনি অনুরোধ করেন তার নাম প্রকাশ না করার জন্য। আর সার্টিফিকেট ব্যবসায় মাধ্যম হিসেবে থাকা এক ব্যবসায়ী জানান ৮০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা দিলেই এই এশিয়ান ইউনিভার্সিটির সার্টিফিকেট পাওয়া যাবে। প্রাইম ইউনিভার্সিটি : মালিকানা দ্বন্দ্বের কারণে প্রাইম ইউনিভার্সিটি দুটি ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। একটি উত্তরা অন্যটি মিরপুরে। উভয় পক্ষই নিজেদের বৈধ বলে দাবি করছে। তবে প্রাইম ইউনিভার্সিটির উভয় পক্ষই জড়িত সার্টিফিকেট ব্যবসায়। টাকার বিনিময়ে প্রতিনিয়ত শিক্ষার্থীরা সার্টিফিকেট নিয়ে যাচ্ছেন এই প্রতিষ্ঠান থেকে। এমনকি অনেকে আইন বিভাগ থেকে সার্টিফিকেট নিয়ে আইনজীবী হওয়ারও আশা প্রকাশ করেছেন। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রাইম ইউনিভার্সিটির মিরপুরের দারুস সালাম রোড শাখায় ভর্তি হয়েছিলেন মিজানুর রহমান ফোরকান। তিনি একটি বেসরকারি কলেজের প্রভাষক। এলএলবিতে ভর্তি হয়েছিলেন প্রাইম ইউনিভার্সিটিতে। সেখান থেকে দুই বছরে তিনি এলএলবি পাস করেছেন। এজন্য টাকা দিতে হয়েছে ৫২ হাজার। তাকে ক্লাস করতে হয়নি। তিনি শুধু ইয়ার ফাইনাল পরীক্ষা দিয়েছেন। আর কোনো পরীক্ষা বা ক্লাস করেননি। তবে দুই বছর পর ঠিকই সনদ পেয়ে গেছেন ফোরকান। একই অবস্থা উত্তরার শাখাটিতে। ক্লাস না করে পরীক্ষা না দিয়ে এমবিএ সার্টিফিকেট পেয়ে গেছেন ময়মনসিংহের রবিউল। ইবাইস ইউনিভার্সিটি : মালিকানা দ্বন্দ্বের পাশাপাশি সার্টিফিকেট বাণিজ্যে জড়িত এই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়টি। বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রতিষ্ঠাতা জাকারিয়া লিংকন মালিকানা দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েছেন তার ভাই কাওসার হোসেন ও দেশের নামকরা একজন শিল্পপতির ছেলে শওকত আজিজ রাসেল। এরপর উভয়পক্ষে শুরু হয় মামলার প্রতিযোগিতা। মালিকানার জের ধরে ইবাইস ইউনিভার্সিটির নামে রাজধানীর মোহাম্মদপুর, উত্তরা ও ধানম-িতে অবৈধ ক্যাম্পাস পরিচালনা করছে শিক্ষা ব্যবসায়ীরা। উভয় পক্ষই একে অপরের বিরুদ্ধে সনদ বিক্রির অভিযোগ তুলছে। তাদের অভিযোগ সত্য হলেও দুই পক্ষই টাকার বিনিময়ে সনদ বিক্রি করে। প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটি : প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটির ইংলিশ রোড ক্যাম্পাসসহ আরও কয়েকটি চলছে অবৈধভাবে। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি পক্ষ পুরনো সনদ ও পিএইচডি ডিগ্রি ব্যবসায়ী। বিশ্ববিদ্যালয়টিতে সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, এখানে আসা বেশিরভাগই বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরিরত কিংবা দীর্ঘদিন ধরে পড়াশোনায় বিরতি দিয়েছেন। ফলে চাকরিতে পদোন্নতি কিংবা সার্টিফিকেটের জন্য অপেক্ষমান চাকরি পেতেই এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিড় করেছেন। টাকা দিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন কাক্সিক্ষত সার্টিফিকেট। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে তথ্য থাকছে চার বছর অধ্যয়ন করে অনার্স ও এক বছর অধ্যয়ন করে মাস্টার্স সার্টিফিকেট পাচ্ছেন। অতীশ দীপংকর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় : দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা মালিকানা দ্বন্দ্ব আপাতত নিরসন হলেও এ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধেও রাজধানীর পান্থপথ, মিরপুর, মতিঝিলসহ বিভিন্ন স্থানে অবৈধ ক্যাম্পাস খোলার অভিযোগ রয়েছে। নামপ্রকাশ না করে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন পরিচালক জানান, দখলদার হিসেবে পরিচিত ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন পরিচালক যিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, তিনিই বেপরোয়াভাবে ক্যাম্পাসগুলো খুলেছেন। প্রত্যেকটি ক্যাম্পাসেই শিক্ষা ও সনদ বাণিজ্য চলছে নিয়ন্ত্রণহীনভাবে। কুইন্স ইউনিভার্সিটি : উচ্চশিক্ষার সার্টিফিকেট ব্যবসায় পুরনো ব্যবসায়ী হিসেবে এই বিশ্ববিদ্যালয়টি পরিচিত। সরকার বিশ্ববিদ্যালয়টি বন্ধ ঘোষণা করলেও আদালতের আশ্রয় নিয়ে পুরোদমে চালিয়ে যাচ্ছে সার্টিফিকেট ব্যবসা। উচ্চশিক্ষা কেন্দ্রের পরিবর্তে কুইন্স ইউনিভার্সিটি এখন সার্টিফিকেট বাণিজ্য কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। চট্টগ্রামের সাউদার্ন ইউনিভার্সিটি : চট্টগ্রামের এই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়টি অনেকটা প্রকাশ্যেই সনদ বাণিজ্যে লিপ্ত রয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। ক্লাসপরীক্ষা না নিয়েই কেবল টাকার বিনিময়ে দেয়া হচ্ছে সার্টিফিকেট। আর অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের ক্লাসপরীক্ষায় শিথিল করিয়ে করা হচ্ছে এই কাজ। তবে প্রকাশ্যে না হলেও পর্দার অন্তরালে থেকে দ্য পিপলস ইউনিভার্সিটি, গ্রিন ইউনিভার্সিটি, সিলেটের লিডিং ইউনিভার্সিটি, ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, উত্তরা ইউনিভার্সিটির বিরুদ্ধে সার্টিফিকেট বাণিজ্যের অভিযোগ রয়েছে। টাকার বিনিময়ে সারাদেশে সার্টিফিকেট মিলছে বলে অভিযোগ করেছেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এবং পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিআরসি) চেয়ারম্যান হোসেন জিল্লুর রহমান। টাকার বিনিময়ে সার্টিফিকেট মেলার প্রধান কারণ হিসেবে তিনি ভুল শাসন ব্যবস্থাকে দায়ী করেন। তিনি বলেন, ভুল শাসন ব্যবস্থার কারণে অনেক প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির জন্ম হয়েছে এবং হচ্ছে। এদের ওপর নিয়ন্ত্রণ না থাকার কারণে তারা যত্রতত্র সার্টিফিকেট বিক্রি করছে। যার প্রভাব পড়ছে শিক্ষার গুণগত মানের ওপর।’ এ বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলা নাহিদ বলেছেন, ১৫টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দেয়া দরকার। কিন্তু আদালতের স্থিতাদেশ থাকায় তা পারা যাচ্ছে না। ক্ষমতা আমাদের হাতে নেই। তবে যেদিন রায় দেবে, পরের দিনই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বন্ধ করে দেয়া হবে।
সুত্রঃ দৈনিক ইনকিলাব, ঢাকা, সোমবার, ০১ সেপ্টেম্বর ২০১৪
ঢাকা, সোমবার, ০১ সেপ্টেম্বর ২০১৪
ঢাকা, সোমবার, ০১ সেপ্টেম্বর ২০১৪
কিন্তু এসব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস হয় না নিয়মিত, ভালোমানের ও যোগ্য শিক্ষক নেই, পরীক্ষাও দিতে হয় না। কিন্তু মিলছে সনদ। বিধান অনুযায়ী অনার্স সার্টিফিকেটের জন্য চার বছর এবং মাস্টার্স সার্টিফিকেটের জন্য এক বছর পড়াশোনা করতে হয়। এরপরই মিলে উচ্চশিক্ষার কাক্সিক্ষত সেই সার্টিফিকেট। কিন্তু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিয়মনীতি কিংবা বিধানকেই তোয়াক্কা না করে বরং টাকা দিলেই সাথে সাথেই দিয়ে দেয়া হচ্ছে উচ্চশিক্ষার এই সার্টিফিকেট। আর এসব সার্টিফিকেট দিয়েই অনেকে অংশ নিচ্ছেন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা কিংবা নিয়োগ পাচ্ছেন চাকরিতে। পদন্নোতিও হচ্ছে অনেকের। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বিপাকে পড়তে হয় এসব প্রতিষ্ঠান থেকে সনদ নেয়াদের। অনেক চাকরিদাতা প্রতিষ্ঠানেই মূল্যায়ন হয় না তাদের সার্টিফিকেট। কিন্তু তারপরও নানাভাবে আকৃষ্ট করার চেষ্টা চালাচ্ছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কেবলই সার্টিফিকেটনির্ভর বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে ইতোমধ্যে পরিচিত হয়ে পড়েছে অন্তত ১৫টি বিশ্ববিদ্যালয়। ৩০ থেকে ৫০ হাজার টাকা দিলেই মিলছে আমেরিকা বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটির সার্টিফিকেট। এর থেকে একটু বেশি দিলেই মিলছে প্রাইম ইউনিভার্সিটি, দারুল ইহসান, এশিয়ান, প্রিমিয়ার, কুইন্স ইউনিভার্সিটির সার্টিফিকেট। দেড় লাখ থেকে দুই লাখ টাকায় মিলছে ইবাইস, অতীশ দীপংকর, দ্য পিপলস, উত্তরা, সিলেটের লিডিং, ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল, রয়েল, গ্রিন, চট্টগ্রামের সাউদার্ন ইউনিভার্সিটির সার্টিফিকেট। পাঁচ থেকে আট লাখ টাকা দিলে দেশের শীর্ষ প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়েরও সার্টিফিকেট পাওয়া যাচ্ছে বলেও জানিয়েছে এই বাণিজ্যে সংযুক্ত কয়েকজন ব্যবসায়ী। জানা গেছে, বিবিএ, এলএলবি, এমবিএ, এলএলএম, বিএড, এমএড, বাংলা, ইংরেজি, কম্পিউটার সায়েন্স এবং সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংসহ বিভিন্ন বিষয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করতে শিক্ষার্থীকে কমপক্ষে ৪ থেকে ৬ বছর অধ্যয়ন করতে হয়। এ সময়ে বিভিন্ন পরীক্ষাসহ নানা ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার মুখোমুখি হতে হয় শিক্ষার্থীকে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, দীর্ঘ সময়ক্ষেপণ ও ঝক্কিঝামেলা মুক্ত সার্টিফিকেট পাওয়ার সব ধরনের ব্যবস্থা রয়েছে আমেরিকা বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটিতে। শুধু এই ইউনিভার্সিটিই নয়; নিজেদের নিরাপদ রাখতে এবং ব্যবসা সম্প্রসারণে তারা অতীশ দীপংকর ও চট্টগ্রামের সাউদার্ন ইউনিভার্সিটির সঙ্গে গোপন চুক্তি করে। ৮০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা দিয়ে এই দুই ইউনিভার্সিটি থেকে সার্টিফিকেট কিনে তা এক থেকে দেড় লাখ টাকায় শিক্ষার্থীদের কাছে বিক্রি করে। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, মাত্র ১০-১২ ব্যক্তি বছরের পর বছর মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করে উচ্চশিক্ষার সনদ নামের মূল্যহীন কাগজ বিলি করছেন। অনেকটা লাগামহীন ব্যবসার সুযোগ থাকায় অনেকে পারিবারিকভাবেও এই জাল-জালিয়াতির রাস্তায় নেমে পড়েছেন। আর এদের নানাভাবে মদদ দিয়ে যাচ্ছেন শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) দুর্নীতিবাজ কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী। মূলত শক্তিশালী সিন্ডিকেটের কারণেই প্রতারণার ব্যবসাসহ অবৈধ বিশ্ববিদ্যালয় এবং ক্যাম্পাস যেমন বন্ধ হচ্ছে না, তেমনি অপরাধীরাও থেকে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থিক নৈরাজ্য ও সার্টিফিকেট ব্যবসাসহ নানা প্রতারণামূলক কর্মকান্ডের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে জাতীয় সংসদের শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি তথ্য তলব করে। গত ২৬ জুন শিক্ষা মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে ১৯ পৃষ্ঠার তথ্য পাঠায় জাতীয় সংসদে। এতে অকপটে নানা ধরনের অনিয়ম-দুর্নীতির কথা উল্লেখ করেছে মন্ত্রণালয়। সর্বশেষ গত ৩০ জুন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। তাদের প্রতিবেদনে বলা হয়, ক্লাস না করিয়ে ও পরীক্ষা না নিয়ে এবং ব্যবহারিক ক্লাস না নিয়ে টাকার বিনিময়ে সনদ প্রদান করা হচ্ছে। তাদের গবেষণায় জনপ্রতি ৩ লাখ টাকা করে নিয়ে এ রকম একটি বিশ্ববিদ্যালয়েরই ৩০০ শিক্ষার্থীকে সনদ দেয়ার ঘটনা বেরিয়ে এসেছে। বুলবুল আহমেদ নামে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক বলেন, আমি যখন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম ক্লাস নেয়া শুরু করি তখন শতভাগ দেয়ার ইচ্ছে নিয়েই শুরু করেছিলাম। এরপর প্রথম পরীক্ষা শেষে যখন শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার খাতা দেয়া হলো তখন নির্ধারিত সময়ের পূর্বেই নম্বর চাওয়া হলো। তিনি জানালেন খাতা দেখা শেষ হয়নি। তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে বলা হলো খাতা দেখা লাগবে না সবাইকে ভালোভাবে নম্বর দিয়ে দেন। নম্বর কম পেলে ছাত্ররা এখানে ভর্তি হবে না। আর আপনিও শিক্ষক থাকতে পারবেন না। রাজধানী ছাড়িয়ে সারাদেশে : সনদ বাণিজ্য অত্যন্ত লাভজনক ও লোভাতুর ব্যবসা হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার পর সার্টিফিকেট বিক্রির মতো লাভজনক এই বাণিজ্য এখন আর কেবল রাজধানীতেই সীমাবদ্ধ নেই। রাজধানী ছাড়িয়ে পৌঁছে গেছে দেশের সব বিভাগীয় এবং বড় বড় জেলা শহরগুলোতে। বেসরকারি হিসেবে এ ধরনের বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা অন্তত সাড়ে তিনশ। এর মাধ্যমে তারা শিক্ষার্থীদের প্রতারিত করার পাশাপাশি হাতিয়ে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকা। জানা গেছে, এসব বিশ্ববিদ্যালয় কেবল সনদধারী গ্রাজুয়েটই নয়, কাঁড়ি কাঁড়ি শিক্ষকও তৈরি করছে। নানা শ্রেণী-পেশার মানুষকে ধরে এনে এসব প্রতিষ্ঠানে নামমাত্র পয়সায় শিক্ষকতার দায়িত্ব দেয়া হচ্ছে। গত ১৩ আগস্ট প্রকাশিত হয়েছে এইচএসসি পরীক্ষার ফল। ৭০ হাজারেরও বেশি শিক্ষার্থী জিপিএ-৫ পেয়েছে এই পরীক্ষায়। দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে রয়েছে আসন সমস্যা। জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীরাই ২০ হাজারের বেশি এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পাবে না। এছাড়া অন্যান্য জিপিএ ধারীরাতো আছেই। ফলে অনেকটা বাধ্য হয়েই অনেকে ঝুঁকবেন এই প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দিকে। অথচ দেশে বর্তমানে অবৈধ ও ভুয়া হিসেবে চার ধরনের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এগুলো হচ্ছে- এক সময়ে সরকার অনুমোদিত কিন্তু বর্তমানে বন্ধ ঘোষিত, সরকার অনুমোদিত হলেও তার ক্যাম্পাস অবৈধ, অবৈধ আউটার ক্যাম্পাস এবং অবৈধ বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়। এর বাইরে ৪টি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে যারা মালিকানা দ্বন্দ্ব থেকে সার্টিফিকেট বিক্রির প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছেন। মালিকানা দ্বন্দ্বের কারণে একই নামের দুটি পৃথক বিশ্ববিদ্যালয় এবং দু’জন পৃথক ভিসির স্বাক্ষর করা সার্টিফিকেট নিয়ে বের হচ্ছে শিক্ষার্থীরা। এর কোনটি আসল কিংবা কোনটি নকল তা নিয়ে যেন কারোরই মাথা ব্যথা নেই। সার্টিফিকেট সর্বস্ব গ্রাজুয়েট তৈরি করছে, এমন বিশ্ববিদ্যালয়ও রয়েছে অন্তত ১৫টি। আর ঢাকার বাইরের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো প্রায় অভিভাবক ছাড়াই চলছে। অনেকটা এক হাতে টাকা তো অন্য হাতে সার্টিফিকেট ধরনের। ওইসব প্রতিষ্ঠানে কখনও শিক্ষার্থীরা ভর্তি হয় ও কোনো রকমে লেখাপড়া করে সনদ নেয়। আবার কখনও শিক্ষার্থীরা কাগজে-কলমে ভর্তি হয়েই রাতারাতি অনার্স-মাস্টার্স ডিগ্রিধারী হয়ে যাচ্ছে। দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয় : এই বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে সনদ বাণিজ্যের অভিযোগ ও প্রমাণ দুটোই আছে। এমনকি তাদের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সনদ নিয়ে চাকরি প্রার্থী হয়ে হতাশ হতে হচ্ছে অনেক শিক্ষার্থীকেও। টাকা দিলেই এই বিশ্ববিদ্যালয়টির সনদ হাতে এমন কথা চালু আছে সবখানে। বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশনও এসব অভিযোগ তুলে বিশ্ববিদ্যালয়টি বন্ধ করে দেওয়ার সুপারিশ করেছে। এরপরই চার ভাগে বিভক্ত এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি পক্ষই আদালতে গিয়ে স্থগিতাদেশ নিয়ে এখন বহাল তবিয়তে চলছে। ইউজিসির তথ্য মতে রাজধানীতেই দারুল ইহসানের নামে চলছে শতাধিক অবৈধ ক্যাম্পাস। একেকটি ক্যাম্পাস থেকে গড়ে প্রতি মাসে এক কোটি টাকার সনদ বাণিজ্য হয়। চারটি ক্যাম্পাস থেকেই সনদ দেওয়া হচ্ছে দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয় নামে। কোনটি আসল আর কোনটি নকল জানতে পারছে না শিক্ষার্থীরা। এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ : সার্টিফিকেট বিক্রিতে এশিয়ান ইউনির্ভার্সিটি অনেকটা টাকা দাও সনদ নাও ধরনের। অভিযোগ রয়েছে, বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষায় সনদ বাণিজ্যের পথিকৃৎ এই বিশ্ববিদ্যালয় এবং এর ভিসি। টিআইবি’র প্রতিবেদনেও এই তথ্য এসেছে। বিশ্ববিদ্যালয়টি সম্পূর্ণ সনদনির্ভর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বলে উল্লেখ করেছে তাদের তদন্ত প্রতিবেদনে। ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের এক কর্মকর্তার সাথে যোগাযোগ করলে তিনি জানান, এখানে ভর্তি হলে নিয়মিত ক্লাস না করলেও চলবে। তবে কোর্স ও টিউশন ফি নিয়মিত দিতে হবে। ওই কর্মকর্তাকে সাংবাদিক পরিচয় দেয়ার পর তিনি অনুরোধ করেন তার নাম প্রকাশ না করার জন্য। আর সার্টিফিকেট ব্যবসায় মাধ্যম হিসেবে থাকা এক ব্যবসায়ী জানান ৮০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা দিলেই এই এশিয়ান ইউনিভার্সিটির সার্টিফিকেট পাওয়া যাবে। প্রাইম ইউনিভার্সিটি : মালিকানা দ্বন্দ্বের কারণে প্রাইম ইউনিভার্সিটি দুটি ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। একটি উত্তরা অন্যটি মিরপুরে। উভয় পক্ষই নিজেদের বৈধ বলে দাবি করছে। তবে প্রাইম ইউনিভার্সিটির উভয় পক্ষই জড়িত সার্টিফিকেট ব্যবসায়। টাকার বিনিময়ে প্রতিনিয়ত শিক্ষার্থীরা সার্টিফিকেট নিয়ে যাচ্ছেন এই প্রতিষ্ঠান থেকে। এমনকি অনেকে আইন বিভাগ থেকে সার্টিফিকেট নিয়ে আইনজীবী হওয়ারও আশা প্রকাশ করেছেন। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রাইম ইউনিভার্সিটির মিরপুরের দারুস সালাম রোড শাখায় ভর্তি হয়েছিলেন মিজানুর রহমান ফোরকান। তিনি একটি বেসরকারি কলেজের প্রভাষক। এলএলবিতে ভর্তি হয়েছিলেন প্রাইম ইউনিভার্সিটিতে। সেখান থেকে দুই বছরে তিনি এলএলবি পাস করেছেন। এজন্য টাকা দিতে হয়েছে ৫২ হাজার। তাকে ক্লাস করতে হয়নি। তিনি শুধু ইয়ার ফাইনাল পরীক্ষা দিয়েছেন। আর কোনো পরীক্ষা বা ক্লাস করেননি। তবে দুই বছর পর ঠিকই সনদ পেয়ে গেছেন ফোরকান। একই অবস্থা উত্তরার শাখাটিতে। ক্লাস না করে পরীক্ষা না দিয়ে এমবিএ সার্টিফিকেট পেয়ে গেছেন ময়মনসিংহের রবিউল। ইবাইস ইউনিভার্সিটি : মালিকানা দ্বন্দ্বের পাশাপাশি সার্টিফিকেট বাণিজ্যে জড়িত এই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়টি। বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রতিষ্ঠাতা জাকারিয়া লিংকন মালিকানা দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েছেন তার ভাই কাওসার হোসেন ও দেশের নামকরা একজন শিল্পপতির ছেলে শওকত আজিজ রাসেল। এরপর উভয়পক্ষে শুরু হয় মামলার প্রতিযোগিতা। মালিকানার জের ধরে ইবাইস ইউনিভার্সিটির নামে রাজধানীর মোহাম্মদপুর, উত্তরা ও ধানম-িতে অবৈধ ক্যাম্পাস পরিচালনা করছে শিক্ষা ব্যবসায়ীরা। উভয় পক্ষই একে অপরের বিরুদ্ধে সনদ বিক্রির অভিযোগ তুলছে। তাদের অভিযোগ সত্য হলেও দুই পক্ষই টাকার বিনিময়ে সনদ বিক্রি করে। প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটি : প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটির ইংলিশ রোড ক্যাম্পাসসহ আরও কয়েকটি চলছে অবৈধভাবে। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি পক্ষ পুরনো সনদ ও পিএইচডি ডিগ্রি ব্যবসায়ী। বিশ্ববিদ্যালয়টিতে সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, এখানে আসা বেশিরভাগই বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরিরত কিংবা দীর্ঘদিন ধরে পড়াশোনায় বিরতি দিয়েছেন। ফলে চাকরিতে পদোন্নতি কিংবা সার্টিফিকেটের জন্য অপেক্ষমান চাকরি পেতেই এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিড় করেছেন। টাকা দিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন কাক্সিক্ষত সার্টিফিকেট। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে তথ্য থাকছে চার বছর অধ্যয়ন করে অনার্স ও এক বছর অধ্যয়ন করে মাস্টার্স সার্টিফিকেট পাচ্ছেন। অতীশ দীপংকর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় : দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা মালিকানা দ্বন্দ্ব আপাতত নিরসন হলেও এ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধেও রাজধানীর পান্থপথ, মিরপুর, মতিঝিলসহ বিভিন্ন স্থানে অবৈধ ক্যাম্পাস খোলার অভিযোগ রয়েছে। নামপ্রকাশ না করে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন পরিচালক জানান, দখলদার হিসেবে পরিচিত ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন পরিচালক যিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, তিনিই বেপরোয়াভাবে ক্যাম্পাসগুলো খুলেছেন। প্রত্যেকটি ক্যাম্পাসেই শিক্ষা ও সনদ বাণিজ্য চলছে নিয়ন্ত্রণহীনভাবে। কুইন্স ইউনিভার্সিটি : উচ্চশিক্ষার সার্টিফিকেট ব্যবসায় পুরনো ব্যবসায়ী হিসেবে এই বিশ্ববিদ্যালয়টি পরিচিত। সরকার বিশ্ববিদ্যালয়টি বন্ধ ঘোষণা করলেও আদালতের আশ্রয় নিয়ে পুরোদমে চালিয়ে যাচ্ছে সার্টিফিকেট ব্যবসা। উচ্চশিক্ষা কেন্দ্রের পরিবর্তে কুইন্স ইউনিভার্সিটি এখন সার্টিফিকেট বাণিজ্য কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। চট্টগ্রামের সাউদার্ন ইউনিভার্সিটি : চট্টগ্রামের এই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়টি অনেকটা প্রকাশ্যেই সনদ বাণিজ্যে লিপ্ত রয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। ক্লাসপরীক্ষা না নিয়েই কেবল টাকার বিনিময়ে দেয়া হচ্ছে সার্টিফিকেট। আর অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের ক্লাসপরীক্ষায় শিথিল করিয়ে করা হচ্ছে এই কাজ। তবে প্রকাশ্যে না হলেও পর্দার অন্তরালে থেকে দ্য পিপলস ইউনিভার্সিটি, গ্রিন ইউনিভার্সিটি, সিলেটের লিডিং ইউনিভার্সিটি, ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, উত্তরা ইউনিভার্সিটির বিরুদ্ধে সার্টিফিকেট বাণিজ্যের অভিযোগ রয়েছে। টাকার বিনিময়ে সারাদেশে সার্টিফিকেট মিলছে বলে অভিযোগ করেছেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এবং পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিআরসি) চেয়ারম্যান হোসেন জিল্লুর রহমান। টাকার বিনিময়ে সার্টিফিকেট মেলার প্রধান কারণ হিসেবে তিনি ভুল শাসন ব্যবস্থাকে দায়ী করেন। তিনি বলেন, ভুল শাসন ব্যবস্থার কারণে অনেক প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির জন্ম হয়েছে এবং হচ্ছে। এদের ওপর নিয়ন্ত্রণ না থাকার কারণে তারা যত্রতত্র সার্টিফিকেট বিক্রি করছে। যার প্রভাব পড়ছে শিক্ষার গুণগত মানের ওপর।’ এ বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলা নাহিদ বলেছেন, ১৫টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দেয়া দরকার। কিন্তু আদালতের স্থিতাদেশ থাকায় তা পারা যাচ্ছে না। ক্ষমতা আমাদের হাতে নেই। তবে যেদিন রায় দেবে, পরের দিনই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বন্ধ করে দেয়া হবে।
সুত্রঃ দৈনিক ইনকিলাব, ঢাকা, সোমবার, ০১ সেপ্টেম্বর ২০১৪
ঢাকা, সোমবার, ০১ সেপ্টেম্বর ২০১৪
ঢাকা, সোমবার, ০১ সেপ্টেম্বর ২০১৪
dhonnobad, khub valo laglo pore
ReplyDelete